• বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:০৩ অপরাহ্ন

মধ্যবিত্ত ___এস এম নওশের

সম্পাদক ও প্রকাশক - কবি ও সাংবাদিক মোঃ মশিউর রহমান / ১৯ Time View
Update : বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

 

এস এম নওশের:

শ্রেয়া সদ্য জ্বর থেকে উঠেছে। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না তার। এমনিতেই মেয়েটি একেবারে শুকনো, তার ওপর সপ্তাহখানেকের জ্বরে আরও কাহিল হয়ে পড়েছে।

সেদিন হঠাৎ শ্রেয়ার বাবার অফিসে এক অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। অপরিচিত এক নারীকণ্ঠ ভেসে এল।

— “বাবুল সাহেব বলছেন?”
— “জ্বি, বলছি।”
— “আপনি শ্রেয়ার বাবা?”
— “জ্বি।”
— “আমি শ্রেয়ার স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। আজ এক্সাম হলে আপনার মেয়ে শ্রেয়া অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। চিন্তার কিছু নেই, আমরা ডাক্তারের সাহায্য নিয়েছি। এখন জ্ঞান ফিরেছে। তবে ওর শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছেন—সেগুলো করিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে দেখাতে বলেছেন। আপনি দয়া করে দ্রুত এসে মেয়েকে নিয়ে যান।”

ফোনটা কেটে গেল।

বাবুল সাহেবের সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন ছিল। বসকে কিছু না জানিয়ে হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। একটা ট্যাক্সি ধরে ছুটলেন স্কুলের দিকে। কীভাবে পৌঁছালেন, নিজেই জানেন না। শ্রেয়া তাঁর একমাত্র সন্তান—তাঁর সমস্ত স্বপ্ন, ভালোবাসা, দুশ্চিন্তা সব তাকে ঘিরেই।

মাসের শেষ, হাতে টাকা নেই বললেই চলে। কভিডের সময় ভালো চাকরিটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কয়েক মাস বেকার থেকে যে চাকরিটা জুটেছে, তাতে বেতন আগের তুলনায় অর্ধেক। মধ্যবিত্তের জীবনটাই এমন—চিরকাল টানাপোড়েন। গরিব হলে অন্তত সাহায্য চাওয়া যায়, কিন্তু মধ্যবিত্ত? তারা চাইলেও পারে না, বলতেও লজ্জা।

তবু সংকোচ ভুলে, পরিচিতদের থেকে ধার করে বাবুল সাহেব মেয়ের টেস্ট করালেন। পরে শ্রেয়াকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে।

ডাক্তার শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— “আপনার মেয়ে খুবই আন্ডারওয়েট। কী মা, খাওয়া-দাওয়া করিস না? দুধ খাস না? দুধে গন্ধ লাগে?”

শ্রেয়া সলজ্জ হেসে বাবার বুকে মুখ লুকাল।

ডাক্তার আবার বললেন,
— “ওষুধ লিখে দিচ্ছি। তবে শুধু ওষুধে হবে না, খাওয়াদাওয়াতেও মনোযোগ দিতে হবে। মেয়েটার শরীর খুব দুর্বল। মানসিক চাপ যেন না পায়।”

গত সাত দিন ধরে শ্রেয়া কিছুই খেতে চাইছিল না। খাইলেও বমি করে দিচ্ছিল।
আজ একটু ভালো লাগছে। শরীরের জ্বরটা নেই। উঠে বসে বাবাকে বলল,
— “বাবা, কাগজি লেবু মেখে মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খেতে মন চাইছে।”

আজ মাসের একেবারে শেষ দিন। বাবুল সাহেবের পকেটে আছে মাত্র তিনশ টাকা।
বাজারে এলেন। দেশি মুরগি তো পাওয়াই ভার; আর পেলেও দাম আকাশছোঁয়া। কক মুরগির দামও বেশি।

এক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— “ভাই, কক মুরগি কত?”
— “ভাই, দামাদামি কইরেন না। সাড়ে তিনশ টাকা কেজি, একদাম।”

— “আরও একটু কম হয় না?”
— “না ভাই, বাজার খুব চড়া। চাইলে ব্রয়লার নেন, দুইশ আশি কইরা বেচি। আজকে আপনাকে ২৫০ টাকায় দিব।”

— “আচ্ছা, দিন।”

দোকানি খাঁচা থেকে একটা ব্রয়লার বের করল। দেখতে মোটাসোটা। ওজনে এক কেজি আটশ গ্রাম। হিসাব করে বলল,
— “স্যার, ৪৫০ টাকা।”

বাবুল সাহেব একটু লাজুক গলায় বললেন,
— “ভাই, একটু ছোট সাইজের মুরগি দিলে ভালো হতো। এক কেজির নিচে কিছু আছে?”

মুরগিওয়ালা মুখভর্তি পান ফেলে থু করে বলল,
— “এক কেজির নিচে কিছু নাই। যা আছে, সবই বড় সাইজের।”

অনেক খুঁজে বের করল একটা মুরগি—ওজনে এক কেজি তিনশ গ্রাম। দাম ৩২৫ টাকা।

— “ভাই, তিনশ দিলে হয় না?”
— “আরে ভাই, এমনিতেই কমায়া দিছি। আবার দামাদামি করেন ক্যান?”

মাথা নিচু করে বাবুল সাহেব বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। পেছনে শুনলেন দোকানি তার কর্মচারীকে বলছে,
— “দেহছস হালার প্যান্ট-শার্ট পরা ফকিন্নির পোলা আইছে মুরগি কিনতে! হালার বউনিডাই মাডি করল!”

বাবুল সাহেব থেমে গেলেন না। হাঁটতে লাগলেন চুপচাপ। মেয়েটা মুরগি খেতে চেয়েছে, অথচ তিনি কিনে দিতে পারলেন না।
চোখে অশ্রু জমে উঠল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
April 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  

Archive Calendar

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০