আমিরুল ইসলাম জীবন
ফিলিস্তিনে রক্ত ঝরছে। শিশুর কান্না বাতাসে মিশে যাচ্ছে, মা হারানো মুখগুলো ছুটে বেড়াচ্ছে ধ্বংসস্তূপের নিচে। হাসপাতাল ধ্বংস হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ধর্মীয় উপাসনালয় পরিণত হচ্ছে মৃ*ত্যুকূপে। একপাক্ষিক এই হ*ত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছে “আত্মরক্ষা।” আর সেই নামের আড়ালেই বিশ্বের চোখের সামনে ঘটে চলেছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই নারকীয় দৃশ্যপটের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কী করছি? আমরা, মানে বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলাদেশ সরকার?
আমাদের হৃদয়ে ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা ঐতিহাসিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন আমরা বিশ্ব থেকে সহানুভূতি আশা করেছিলাম, তেমনি বহুদিন ধরেই নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার কথা বলে আসছি। পাঠ্যপুস্তকে ফিলিস্তিনের বীরত্বগাঁথা ছিল, মিছিল-সমাবেশে ‘ইনতিফাদা’ শব্দ উচ্চারিত হয়েছে গর্বের সঙ্গে। কিন্তু আজ যখন ইসরায়েল সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চলেছে, তখন বাংলাদেশ সরকার একটি জোরালো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
কূটনৈতিক ভাষা ও নির্লিপ্ত অবস্থান:
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়তো এক-দু’বার বিবৃতি দিয়েছে, “গভীর উদ্বেগ প্রকাশ” করেছে। কিন্তু শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করলেই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? বাংলাদেশের জনগণের বৃহৎ অংশ যখন সোচ্চার, তখন সরকারিভাবে একটি তীব্র নিন্দা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো ভূমিকা, এমনকি মুসলিম ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঐক্য গঠনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘে এখনও ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। ওআইসি’র মধ্যেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ কূটনীতিতে মানবিক সংকটের সময় সাহসী ভূমিকা নেওয়া রাষ্ট্রেরাই ভবিষ্যতে সম্মান পায়।
কেন এই নীরবতা?
প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক—এই নীরবতার পেছনে কি কূটনৈতিক হিসাব? অর্থনৈতিক চাপ? না কি বড় কোনো শক্তির চাপে কণ্ঠ রোধ করা?
আমরা জানি, ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বাংলাদেশ এই ব্লকের একটি বড় বাজার ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ। তাই কি আমরা “সতর্ক” হয়ে চলছি? কিন্তু সেই সতর্কতা যদি আমাদের নৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে, তবে তার কী দাম?
বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব বিবেকের কাছে ন্যায়বিচারের দাবি করতে পারে, তবে ফিলিস্তিনে শিশু হত্যার বিরুদ্ধে নীরব থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
জনতার বিবেক জাগছে, সরকার কবে জাগবে?
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু চুপ করে নেই। তারা জানে ফিলিস্তিনের লড়াই নিছক এক ভূখণ্ডের দাবি নয়, এটা মানবতার প্রশ্ন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিল হয়েছে, ফেসবুক-টুইটার কাঁপছে প্রতিবাদে।
তাহলে সরকারের ভূমিকা এত নিষ্প্রভ কেন? জনগণের সঙ্গে সুর মেলাতে এত দ্বিধা কিসের?
বাংলাদেশ কী করতে পারত?
১. জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারত।
২. ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহ*ত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে উত্থাপন করা যেত।
৩. মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ন্যায়ের পক্ষে একসঙ্গে কণ্ঠ তুলতে পারত।
৪. দেশে সরকারিভাবে মানবিক সহানুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারত।
৫. ত্রাণ পাঠানো, মানবিক সাহায্য, দোয়া মাহফিল ও একাত্মতা প্রকাশের মতো কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেত।
শেষ কথা:
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে বাংলাদেশের নিরবতা কেবল হতাশাজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে।
একটি জাতির বিবেক তখনই জীবন্ত থাকে, যখন সে নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে জানে। আমরা ১৯৭১ সালে সে সাহস দেখিয়েছিলাম। আজ ফিলিস্তিনের প্রশ্নেও আমাদের দাঁড়াতে হবে।
কারণ, আজ যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়াই, তাহলে কাল অন্যায় আমাদের দরজায়ও কড়া নাড়বে।