শহরটা যেন এক অদৃশ্য জালের মধ্যে আটকা পড়েছে। প্রতিটি ইট, প্রতিটি বাতাসের কণা, প্রতিটি মানুষের মুখে একরকম শূন্যতা। এখানে কেউ কারো নয়।
নিলয় চৌধুরী এই শহরেরই একজন বাসিন্দা। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, উচ্চতায় মাঝারি, গড়পড়তা চেহারা। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা—কেউ কেউ বলে, সেই দৃষ্টিতে মায়ার অভাব।
নিলয়ের জীবনটা ছিল নিখুঁত একাকীত্বের ছবি। সে ব্যাংকে চাকরি করে, নিয়মিত অফিসে যায়, মাস শেষে বেতন পায়। অথচ তার জীবনটা যেন কেবল চলার জন্যই চলে, বেঁচে থাকার জন্য নয়।
তার জীবনে ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বন্ধুবান্ধবও নেই তেমন। অফিসের সহকর্মীরা তাকে একরকম ভয়ই পায়। কারণ, সে কখনো মিশতে চায় না, হাসে না, কোনো আলোচনায় অংশ নেয় না।
একদিন অফিস শেষে সে বাসায় ফেরার পথে দেখতে পেল রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধ ভিক্ষা করছে। লোকটার চোখে কেমন একটা করুন আর্তি। কিন্তু নিলয় স্রেফ তাকিয়ে থাকল, তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কেউ যদি তার হৃদয়ের গভীরে তাকাত, তাহলে দেখত সেখানে কোনো দয়া নেই, সহানুভূতি নেই, কেবল এক রোবটের মতো শীতল নিরাসক্ততা।
সেদিন রাতে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল।
স্বপ্নে সে দেখতে পেল, তার চারপাশের মানুষগুলো আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে রাস্তার ধারের দোকানি, তারপর অফিসের বস, তারপর রাস্তায় দেখা বৃদ্ধ। একসময় পুরো শহরটাই শূন্য হয়ে গেল।
কিন্তু সে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। একা।
চারদিকে শুধু এক অনন্ত অন্ধকার।
হঠাৎ সে শুনতে পেল এক গলার শব্দ—
“তুমি কি জানো, তুমি কেমন?”
নিলয় ঘুরে তাকাল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অপরিচিত মানুষ। কিন্তু সে যেন পুরোপুরি মানুষের মতো নয়, যেন ছায়ার মতো কিছু একটা।
“তুমি কে?” নিলয় জিজ্ঞেস করল।
“আমি? আমি সেই প্রতিচ্ছবি, যা তুমি আয়নায় দেখতে পাও না,” রহস্যময় কণ্ঠস্বর বলল।
নিলয় কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করল।
“তোমার মাঝে মায়া নেই, নিলয়। তুমি কেবল নিজের জন্য বাঁচো, অন্যদের জন্য নয়। তাই দেখো, একদিন তুমি একা হয়ে যাবে, যেমন এই স্বপ্নের শহর একা হয়ে গেছে।”
স্বপ্নটা সেখানেই শেষ হয়ে গেল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিলয় প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। তারপর নিজেকে বোঝাল, স্বপ্ন তো স্বপ্নই। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
ধীরে ধীরে তার জীবনে অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করল।
প্রথমে অফিসে গিয়ে দেখল, তার ডেস্কে রাখা কিছু কাগজ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। তারপর তার কলিগরা যেন হঠাৎ করেই তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।
এরপর একদিন এক ভীষণ আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল।
সে অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনা দেখল—একজন বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে গেছে, সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না।
নিলয়ের মনে হলো, এই বৃদ্ধকে কোথায় যেন দেখেছে।
হ্যাঁ, এ তো সেই বৃদ্ধ, যাকে কয়েকদিন আগেও রাস্তার পাশে ভিক্ষা করতে দেখেছিল!
সে কি সাহায্য করবে?
তার ভেতরের মায়াহীন অংশ বলল, “এটা তোমার দায়িত্ব নয়।”
কিন্তু তার ভিতরের আরেকটা অংশ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করল।
নিলয় দুবার ভাবল, তারপর এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে ধরে তুলল। কেউ একজন অ্যাম্বুলেন্স ডাকল।
এরপর যখন সে বৃদ্ধকে হাসপাতালে রেখে বাসায় ফিরছিল, তখন মনে হলো, বুকের ভেতর কিছু একটা নরম হয়ে আসছে।
দিন যেতে লাগল।
নিলয়ের মধ্যে আস্তে আস্তে কিছু পরিবর্তন আসতে লাগল। সে অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে একটু বেশি কথা বলা শুরু করল। বাসার পাশের দোকানদারকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানাল, যা সে আগে কখনো করেনি।
তার এই পরিবর্তন অনেকের চোখেই ধরা পড়ল।
একদিন অফিসের এক জুনিয়র কলিগ এসে বলল, “স্যার, আপনাকে কিছু বলতে চাই।”
নিলয় একটু অবাক হয়ে তাকাল।
“আগে আপনাকে খুব ভয় পেতাম। মনে হতো, আপনি একদম মায়াহীন, একা মানুষ। কিন্তু এখন আপনাকে একটু বদলে যেতে দেখছি। কীভাবে হলো এটা?”
নিলয় একটু হেসে বলল, “হয়তো আমি বুঝতে পেরেছি, মানুষকে একা থাকার জন্য জন্ম দেওয়া হয়নি।”
সত্যিই তো।
জীবনটা কেবল নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও।
কোনো মানুষের মনে মায়া না থাকলে, সে আসলে ধীরে ধীরে নিজেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
নিলয় ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, মানুষের মুখের হাসি, কারো জন্য কিছু করার আনন্দ, ছোট ছোট অনুভূতির উষ্ণতাই আসলে তাকে আবার মানুষ করে তুলছে।
এবং এই প্রথমবার, সে নিজেকে সত্যিকারের জীবিত মনে করল।
[ লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক ]
প্রেরক,
পঙ্কজ শীল
কবি ও কথাসাহিত্যিক
পোস্ট: সাচনা
জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ।