• বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২২ অপরাহ্ন

যে স্মৃতি ভূলতে পারি না_______এম আলী হুসাইন।

এম আলী হুসাইন। / ৩৪ Time View
Update : মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

 এম আলী হুসাইন।

বাবা দুইটি বাংলা বর্ণের যোগফল। কত সুন্দর ও চমৎকার। এই শব্দের সাথে পরিচিত পৃথিবীর সকল বাঙ্গালী। বাবা শব্দের বাংলায় অনেক সমার্থক শব্দ রয়েছে প্রতিটা সমার্থক শব্দও আমাদের পরিচয় খুব সুন্দর ফুটিয়ে তুলে। তাই এলাকার ভিন্নতার কারণে বাবাকে কেউ আব্বা ডাকে, কেউ কেউ বাপ ও বলে। যদিও পিতা, জনক, জন্মদাতাও বুঝায়।

আপনি কিভাবে বাবাকে সম্বোধন করেছেন বা কোন শব্দ ব্যবহার করলে আপনার কাছে ভালো লাগে হয়তো সেই বিষয়টা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে হ্যাঁ আমি বাবাকে আব্বা বলে ডাকতাম। আর শব্দটা আমাদের এলাকায় খুব জনপ্রিয়। প্রায় সবাই নিজ নিজ বাবাকে আব্বা বলে ডাকে।

যেহেতু ঈদ কাছে আর ঈদের বাজার নিয়ে আমার লেখা। আব্বার সাথে প্রথম ঈদ ও শেষ ঈদ উদযাপন। সত্য কিছুটা আনন্দের ও বেদনার স্মৃতি রয়েছে যা অবিশ্বাস্য সত্য। কিছু স্মৃতি যেমন ভূলা যায়না, তেমনি কিছু দুঃখ-সুখ, আনন্দ-বেদনা মুছে দেওয়া যায়না।

তখন আর বয়স কত হবে? নব্বই দশকের শেষের দিকে আমি তখন মাত্র আট-দশ বছরের ছেলে। বাবার সাথে ঈদের বাজারে যাওয়ার বায়না ধরেছি। আব্বা আমাকে নিতে চাইলেন না। কারণ বাড়ী থেকে বাজারের দুরত্ব প্রায় ছয় সাত কিলোমিটার। তখন পায়ে হেটে যাওয়ার মত উপযোগী ছিলনা গ্রামীণ জনপদের সেই রাস্থাটি। কিছু জায়গা নৌকায় আর কিছু জায়গা পায়ে হেটে যেতে হত আবার কাঁদা-পানি যুক্ত কিছু জায়গা পাড়ি দিয়ে মানুষ বাজার করত। তখনকার সময়ের সেই রাস্তাটি আজ পায়ে হেটে চলার উপযোগী হয়েছে। নিয়মিত গাড়ীও চলছে। যাতায়াত সমস্যা যেন আশিভাগ সমাধান হয়েছে।

কিছু করার নাই শেষ অবধি আমাকে সাথে নিয়ে আব্বা ঈদের বাজারে গেলেন। বাজার শেষ করে সন্ধা পর-পর বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন। বাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার আসার পর মনে হল কেরাসিন তেলের বোতল আনেন নাই। বাজারে ভূলে রেখে এসেছেন। কেরসিন তেল হয়তো এই যুগের অনেকেই চিনবে না। এই তেল প্রায় বিলুপ্ত এখন আর সবার ঘরে ঘরে পাওয়া যায়না। অথচ এই তেল দিয়ে নব্বই দশকে সবার ঘরে-ঘরে বাতি জ্বলত।

তাহলে এখন কি করার; আমাকে এখানে একটি গাছের নিচে বসিয়ে রেখে আব্বা আবার বাজারে চলে গেলেন। তিনি বাজারে যাওয়া- আসার মাঝে অনেকটা দেরী হচ্ছে আমার কাছে মনে হল। তাই গাছের পাশে বসে আমি একা-একা কান্না করছিলাম। আমার কান্নার শব্দ যেন ছিল হৃদয়ের গহীন থেকে। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বুকফাটা কান্নার শব্দ চলে যায় রাস্তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া খালে চলমান নৌকার মাঝির কাছে।

নৌকার মাঝি কাছে এসে আমাকে চিনতে পারে। আমি তাকে চিনতে পারি। এতে আমার সাহস হয়। সে ও আমাকে সাহস দেয়। এবং বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিবে বলে আমাকে নৌকায় উঠায়। আমি ও তাদের সাথে মনের আনন্দে বাড়ির দিকে যেতে থাকি। তখন রাত গভীর প্রায় নয়-দশটা এর মাঝে মুশুলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। তাই তারা আমাকে বড় একটা পলিথিনের ভিতরে টুকিয়ে দিল আর আমাকে সিলেটি মজার সন্দেশ বাটার, কেক খেতে দিল। আমি এইগুলো খাচ্ছি আর বৃষ্টির শব্দ অনুভব করছি। পলিথিনের উপরে বৃষ্টির সাথে কিছু শিল ও পড়ছিল যা এখনো অনুভব করছি মনে হচ্ছে। এভাবে পথ চলতে থাকি। নৌপথ ছিল অনেক লম্বা এর মাঝে শিলাবৃষ্টি, তাই ঘন্টা দেড় ঘন্টার স্থলে প্রায় তিন ঘন্টার বেশী সময় লেগেছিল আমাকে বাড়ীতে পৌঁছতে।

 

এখনো মনে হচ্ছে আমি যেন সেদিনের সেই সময়ের স্মৃতিতে ফিরিয়ে গেছি। বাড়ীতে তখন আমাদের দুইটি ঘরের চারটি অংশ ছিল। পূর্ব ঘরের সাথে ছিল রান্নাঘর আর রান্নাঘরের সাথে ছিল বড় জলাশয়। তখন এদিকেই নৌকা⛵ গুলো আটকানো হত। আমাকে নিয়ে আসা ⛵ নৌকা বারান্দার দক্ষিণ পাশেই লেগেছিল। তখনো জুম-জুম বৃষ্টি পড়ছিল। ছোট ফুফু বের হয়ে আমাকে কূলে করে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর নৌকা চালকরা পাশের বাড়ির ছুটই চাচা চলে গেলেন।

আমি তখন অবাক হয়ে থাকিয়ে রইলাম সবার দিকে। সবাই যেন কান্না করছে আমার জন্যে। কিছু বুঝতে পারছিনা। এই সময়ের ভিতরে কি হয়েগেল। বড় চাচা, ছোট চাচা, মা-ফুফু সবার চোখে পানি। পাশে থাকা খেলার সাথী ভাই-বোনরাও আমার জন্যে কাঁদছে। কেউ কিছু বলছেনা। সবার কান্নার মাঝে আমার ঈদ আনন্দ স্লান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সবাইকে দেখি আমার আব্বুকে দেখছি না কেন?? আব্বা-আব্বা বলে ডাকাডাকি করেও কোন সাড়া পেলাম না। সব কয়টি রুম খুঁজে আব্বাকে পাইলাম না। মায়ের কূলে আশ্রয় নিয়ে বললাম: আব্বা কোথায়?

আম্মা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন তোমার বাবা তোমাকে খুঁজতে আবার বাজারে গিয়েছে। তিনি সেখানে আমাকে না পেয়ে বাড়ীতে এসেছিলেন। বাড়ীতে এসে না পেয়ে আবার বাজারে চলে গেছেন। কি কষ্ট!! ছয়-সাত কিলোমিটার পায়ে হেটে চলা তখনকার মানুষের অভ্যাস হলেও একদিনে দুই তিনবার পেরেশানী নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করা সহজ ছিলনা।

তখন তো আর মোবাইল ছিলনা। আর পথ চলাও এত সহজ ছিলনা। কিন্তু কিছু করার নাই। সন্তানের জন্যে মা-বাবারা আরো কত কষ্ট করে যা অপ্রকাশ্য থেকে যায়।

এবার আব্বাকে নিয়ে আসতে ছোট চাচা বড় চাচা বাড়ীর বাহিরে চলে গেলেন। তারা পরিচিত জনদের কাছে খবর দিতে দিতে রাত এগারটায় বাজারে পৌঁছলেন। এবং আব্বাকে নিয়ে বাড়ীতে আসলেন। তখন রাত একটা হয়ে গেল। ঈদের সেই রাত কান্না আর আনন্দে চলে গেল।

আর এইটা ছিল আমার জীবনে বাবার সাথে প্রথব শেষ ঈদের রাত। পরের ঈদ আসার আগেই আব্বা ইহকাল ত্যাগ করেন। তিনি হয়ে যান পরকালের বাসিন্দা। আল্লাহ যেন আমার আব্বাকে জান্নাত দান করেন।

এর পর প্রতি বছর দুইটি ঈদের হিসাব করলেও প্রায় ৫২ টি ঈদ শেষ হল। প্রতিটা ঈদ ও ঈদের বাজার আসলে স্মৃতিতে নতুন করে চলে আসে আমার বাবার সাথে দেওয়া সেই সময়ের স্মৃতিগুলো। যা আমি ভূলতেই পারিনা। বাবা ঈদের বাজারে নিজের পোষাক না কিনলেও সে দিন আমাকে কিনে দিয়েছিলেন নতুন টুপি ও গেঞ্জি। বাবার দেওয়া সেই ঈদ পোষাকগুলো আজ ও যেন অপলক আঁখিদ্বয়ের সামনে ভেসে রয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
March 2025
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728  

Archive Calendar

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০
৩১